নানান সময় নানা চমক দেখাচ্ছে বরখাস্তকৃত পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনা। তদন্তের ছয় বছরে একাধিক মোড় নিয়েছে এ হত্যাকাণ্ড। সময় যত গড়াচ্ছে, হত্যার ঘটনা ততই রহস্যময় হয়ে উঠছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার কারাবন্দি বাবুল আক্তারের পক্ষে মামলার আবেদন করা হয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধানসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ‘রিমান্ডে রোমহর্ষক নির্যাতন ও জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায়ের’ অভিযোগ এনে মামলার আবেদনটি করা হয় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুন্নেছা বেগমের আদালতে।
এরপর এ নিয়ে শুরু হয় নতুন আলোচনা। ওই আবেদনে বলা হয়, সাবেক দুজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম জড়িয়ে বাবুলকে স্বীকারোক্তি দিতে নির্যাতন চালানো হয়।
সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে জানান, আদালত আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে আদেশের দিন নির্ধারণ করেছেন।
বাবুল আক্তার এসপি থাকা অবস্থায় স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার খবর তখন পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছিল পুলিশ কর্মকর্তাদের। তদন্তের একপর্যায়ে নতুন তথ্য দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্র্রেপ্তার করা হয় বাবুল আক্তারকে। বলা হয়, বাবুল আক্তার নিজেই স্ত্রীর খুনি। চমকে ওঠে মানুষ। চাকরি হারান বাবুল। বর্তমানে ফেনী কারাগারে বন্দি তিনি।
২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে মিতুকে হত্যা করে দুরর্¦ত্তরা। এ ঘটনায় নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের আসামি করে মামলা করেন। এরপর তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে একর পর এক রহস্য। এখন বাবুল আক্তার নিজেই আসামি।
মামলার আবেদনে ৫৩ ঘণ্টা রিমান্ডের বর্ণনা
বাবুল আক্তারের পক্ষে আইনজীবী গোলাম মওলা চট্টগ্রামের আদালতে যে মামলার আবেদন করেছেন, তার একটি কপি ঢাকাটাইমসের হাতে এসেছে। আদালতের কাছে নির্যাতনে ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর ১৫(১) এবং ৫(২) ধারায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণের আবেদন করেছেন বাবুল আক্তার।
গোলাম মাওলা ঢাকাটাইমসকে জানান, বাবুল আক্তার কারাবন্দি থাকায় মামলার আবেদনে স্বাক্ষর করতে পারেননি। তার পক্ষে আইনজীবী গোলাম মওলা আবেদনটি আদালতে দাখিল করেন। মামলার আবেদনে স্বাক্ষর এবং ২০০ ধারায় জবানবন্দি নিতে বাবুলকে আদালতে হাজিরেরও আবেদন করা হয়েছে।
ওই আবেদনে বলা হয়েছে, মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুলের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে বাবুলকে পিবিআই-প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশের কথা জানিয়ে পিবিআই অফিসে আসতে বলেন। গত বছরের ১০ মে বাবুল চট্টগ্রামে পৌঁছে পিবিআই অফিসে সন্তোষের কক্ষে যান। সেখানে সাতজনকে আসামি করে একটি খসড়া অভিযোগপত্র দেখানো হয়। পরে তাকে পিবিআইয়ের এসপি নাঈমা সুলতানার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এসপি নাজমুল হাসানসহ ১০-১৫ জন অফিসার ছিলেন। নাজমুল হাসান এ সময় বাবুল আক্তারকে বলেন, ‘তোমাকে আমার অফিসে যেতে হবে। বনজ স্যারের নির্দেশ।’
আবেদনে আরও অভিযোগ আনা হয়, রিমান্ডের নামে বাবুল আক্তারকে ৫৩ ঘণ্টা পিবিআই অফিসে আটকে রেখে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হতো বেঁধে। খাবারের সময় চোখ খোলা হতো। ঘুমাতে দেয়া হতো না। বাবুল তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেই তাকে বসিয়ে রাখা চেয়ারের পেছনে লাথি মারা হতো। মাথার ডান-বাম পাশ থেকে ধাক্কা মারা হতো। তৃষ্ণায় ছটফট করলে পানি দেওয়া হতো বোতলের ছিপিতে (মুখ)। একপর্যায়ে নির্যাতনে নেতিয়ে পড়া বাবুল চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার পর তাকে হাতাওয়ালা চেয়ার দেয়া হয়। দুই হাত হাতকড়া দিয়ে চেয়ারের দুই হাতার সাথে বেঁধে রাখা হতো। দুর্ব্যবহারের পাশাপাশি ভয় দেখানো হতো। আর বলা হতো, মিতুকে হত্যার কথা স্বীকার করে পুলিশের ছক অনুযায়ী আদালতে জবানবন্দি দিতে।
২১ পৃষ্ঠার ওই আবেদনে আরো বলা হয়, সাদা কাগজে ও বিভিন্ন বইয়ের পাতায় বাংলা ও ইংরেজিতে পুলিশ কর্মকর্তা নাজমুল হাসান ও নাঈমা সুলতানার শিখিয়ে দেওয়া বিভিন্ন কথা সন্তোষ কুমার চাকমা বাবুলকে লিখতে বাধ্য করেন। ছয় পুলিশ কর্মকর্তা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য বাবুল আক্তারকে নানাভাবে ভয় দেখান। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নানা প্রলোভনও দেখানো হয়।
বাবুলকে কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, তা ঢাকায় বসে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পিবিআই-প্রধান বনজ কুমার মজুমদার মনিটরিং করেন বলে অভিযোগ করা হয় বাবুল আক্তারের আবেদনে।
আরও অভিযোগ করা হয়, জবানবন্দিতে বাবুল কী বলবেন সেটি একটি কাগজে লিখে তাকে পড়ে শোনানো হয়। সন্তোষ কুমার চাকমা ও একেএম মহিউদ্দিন কয়েকটি কাগজে বাংলা ও ইংরেজিতে স্বাক্ষর নেন। বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশের কথা বলে ক্যামেরায় রেকর্ড করে বাবুলের জবানবন্দি নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। দুজন সাবেক সিনিয়র অফিসারের নাম জড়িয়ে তাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে বলা হয়।
রিমান্ড শেষে ১৭ মে বাবুলকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পুলিশ নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার বাইরে অন্য কোনো সংস্থা দিয়ে অভিযোগের তদন্ত দাবি করেন আবেদনে।
যা বলছেন মিতুর বাবা
মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কখনও বলিনি যে মিতু হত্যার সাথে বাবুল আক্তার জড়িত নয় বা জড়িত আছে। সব সময় বলেছি মিতু হত্যার সাথে যেই জড়িত থাকুক তার শাস্তি চাই।
মিতু হত্যার ঘটনায় প্রথমে বাবুল আক্তার মামলা করেন অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে। দীর্ঘ তদন্তের পর বেরিয়ে আসে বাবুল আক্তারের জড়িত থাকার কথা। এরপর বাবুল আক্তারকে আসামি করে মামলা করেন মিতুর বাবা।
কী বলছে পিবিআই
পিবিআই-প্রধান বনজ কুমার মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই চার্জশিট দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। বিষয়টি টের পেয়ে তদন্ত বিলম্ব করানোর জন্য এই ধরনের কাজ (বাবুলের মামলার আবেদন) করা হয়েছে।’
মিতু মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে মামলার তদন্তভার ন্যস্ত করা হয়। সেখান থেকে তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
সুত্র: ঢাকাটাইমস্
পাঠকের মতামত